বৃদ্ধাশ্রমের করুণ চক্র
ছবিঃ projonmonews24.com (Google Search)
লেখিকাঃ নাজরাতুন নাঈম মামদুদা
শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
রুম থেকে বের হওয়ার সময় ষাটোর্ধ বয়স্ক শাশুড়ী বাচ্চা মানুষের মত ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন, উনি কেন জানি বের হতেই চাইছেন না।
....ওদিকে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। 
ফিরে এসে অফিসের কাগজপত্র গোছানোর কথা ভেবে আমার বিরক্তিটা বেড়েই যাচ্ছে। 
"বউমা, আর একটা দিন তোমাদের সাথে থেকে যাই মা?"
বলেই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন।
বিরক্তিটা চরমে উঠে গেল। কিছু বলতে গিয়েও মুখকে সংযত রেখে অস্ফুট স্বরেই বললাম 
"বৃদ্ধাশ্রমেই তো নিয়ে যাচ্ছি,  জমের দরবারে তো আর না।" 
...পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে  দেখলাম, বেলকনিতে দাড়িয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে অভ্রর বাবা কি যেন ভাবছে। দেখে মনে হলো কিছুক্ষণ আগেই মানুষটা ফুপিয়ে কেঁদেছে। কিছু জিজ্ঞেস না করে আলতো করে তার কাঁধে হাতটা রাখতেই সে কেঁপে উঠলো।
অভ্র আমাদের একমাত্র সন্তান। নিজের ক্যারিয়ার গোছানো নিয়ে আমি এতটাই ব্যস্ত যে দ্বিতীয় বাচ্চার কথা ভাবাই হয় নি। আর সেখানে বৃদ্ধা শ্বাশুড়ির সেবা যত্নের ভার!! 
প্রশ্নই আসে না! 
অভ্রর বয়স তখন নয় ছুঁই ছুঁই। 
....স্কুল থেকে শিক্ষা সফরের কথা শুনে আমি আর অমত করি নি।
শিক্ষা সফর থেকে ফিরে এসে আমার সাথে কথাটি পর্যন্ত বলে নি।....চকলেট পাগল ছেলেকে এতসব চকলেটের সারপ্রাইজ দেওয়া সত্বেও তার চোখে  খুশির লেশমাত্র দেখতে না পেয়ে, 
বড্ড চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।
সকাল সকাল চলে গেলাম অভ্রর স্কুলে। ক্লাস টিচারের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম -- শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া বৃদ্ধাশ্রমে নাকি একজন বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিল। 
আমার তখন বোঝার আার কিছু বাকী রইলো  না।
....দেখতে দেখতে আমার ছোট্ট ছেলেটা যেন হুট করে বড় হয়ে গেল। স্কুল গেইটে দিয়ে আসা ছেলেটা এখন ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে গেছে।
রিটায়ারের পর থেকে আমার খুব ক্লান্ত লাগে, আগের মত চোখেও দেখি না। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কপালে গালে ভাজ পড়ে গেছে। 
বয়স তো অনেক হয়েছে!!
ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে জীবনের এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে।..... এইবার তো নাতি নাতনি দেখে যাওয়া চাই!!
ধুমধামে ছেলেকে বিয়ে করে নিয়ে এলাম। বউটা আমার মাশাল্লাহ --যেমন সুন্দরী, তেমনি শিক্ষিতা।
বছর খানিক বাদে, 
আমার সুখের গতিকে আরও একধাপ বাড়িয়ে দিতে চলে এলো আমার "বংশের প্রদীপ"। 
..........কিন্তু, 
ইদানিং আমি কেমন জানি দিশাহীন হয়ে যাচ্ছি। রাত্রিবেলা টয়লেটটা খুঁজে পেতে হিমসিম খেয়ে যাই। মাঝেমধ্যে ঘরটাও নোংরা হয়ে যায়।
জানো, 
কিছুদিন থেকে নাহ,আমার হাত দুটো কাঁপে। বউমার বাবার দেওয়া প্লেটটাও আমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। 
অভ্রটাও যে খুব ব্যস্ত!!  গতমাসে বলেছিল ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে, আর সময় করতে পারছে না।"-- মৃত স্বামীর ছবির সামনে দাড়িয়ে বিড়বিড় করছিলাম।
আজ মঙ্গলবার! 
আমার ব্যাগ সব গুছিয়ে দিয়েছে বউমা।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে একস্ট্রা কেয়ার দেওয়া হয়।
খুব ইচ্ছে করছিল নাতি-সন্তানের সাথে অন্তত আর একটা দিন থেকে যাই। কথাটা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। 
মাথার ভেতর অস্ফুটস্বরে শুনতে পেলাম----
" বৃদ্ধাশ্রমেই তো যাচ্ছেন। 
.....জমের দরবারে তো আর না!"

No comments